Tuesday, April 24, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৭

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৭

হঠাৎ করেই খেয়াল চাপলো যে পাশের দেশ জার্মানী থেকে একটু ঘুরে আসি। ব্যস, 'ওঠ্‌ ছুড়ি তোর বিয়ে'-র মত ট্রেনে চেপে বসলাম। আমি এমনিতে কিন্তু হুজুগে বাঙালী নই, তবে বিদেশে এসে বোধহয় বাঙালীআনাটা বেড়ে যায়। তাই আমাকেও হুজুগ পেয়ে বসলো। ইউরোপের এই শেঙ্গেন-ভূক্ত দেশগুলো যেন নিজেদের মধ্যেকার রাজনৈতিক সীমারেখাগুলো ম্যাপ থেকে মুছে ফেলেছে। এদের মধ্যে অবাধ যাওয়া আসা সৌহার্দ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। শেঙ্গেন-এর যেকোন একটা দেশে ঢুকলে অন্য দেশগুলোতে যাওয়া মানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া। কেউ কোথাও আপনাকে থামাবে না, কিছু জিজ্ঞেসও করবে না! তারপরও তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় আছে, নিজ নিজ সরকার, অর্থনীতি রয়েছে। এক দেশের মধ্যে দিয়ে আরেক দেশের মাল-বোঝাই ট্রাক গেলে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হয় না। দেশও অন্য দেশের কাছে বিকিয়ে যায় না। অনেকগুলো দেশ মিলিয়ে যেন একটা দেশ। আমি বলি 'দেশপুঞ্জ'। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান মিলিয়ে কি এমন দেশপুঞ্জ গড়া কোনদিন সম্ভব হবে?

জার্মানীর ড্যুসেলডর্ফ শহরটা আমার খুব চেনা। প্রতি বছরই আমার এখানে অন্ততঃ একবার আসা হয়। আমার বাঙালী মামা ও জার্মান মামী থাকেন এখানে গত সত্তর বছর ধরে। এঁদের অনুপ্রেরণায়ই (আর স্টেফী গ্রাফের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে) জার্মান শিখেছিলাম ছোটবেলায় আমি। ভালই বলতে-লিখতে পারতাম। এখন কাজ চালানোর মত পারি। রোববার, তাই দোকানপাট সব বন্ধ। মামা-মামীর সাথে ঘন্টা খানেক গল্পস্বল্প করে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। অদূরেই রাইন নদী। তার তীরে আল্টস্টাড বা পুরোনো শহর। ইউরোপের শহরগুলোর পুরোনো অংশেই যতরকম হই-হুল্লোড়, ভাল রেস্তোঁরা আর পর্যটকদের ভীড়। আমাদের পুরোনো ঢাকাতেও ভাল খাবারের দোকান আছে, কিন্তু বাড়ীঘর, রাস্তাঘাট এতটাই অবহেলিত, যে সেখানে কেউ হই-হুল্লোড় করতে যায়না।

আমার সফরসঙ্গীরা আজ ব্রাসেলস্‌ থেকে হেগে গেছেন। আর আমি বাড়ীর পথে। আবার সেই আবু-দু'ভাই! একটা জিনিস ভেবে বেশ আরাম লাগছে যে শৌচকার্যে আর কাগজ ব্যবহার করতে হবে না। জানিনা, বিদেশীরা পানি বাঁচিয়ে করেটা কী! ডিজিটাল যুগে যখন সবকিছু আস্তে আস্তে পেপারলেস হয়ে যাবে, তখন ওরা টয়লেটে যাবে কীভাবে? ব্রাসেলসের হোটেলে অবশ্য ফ্রেঞ্চ বিডে ছিল। কিন্তু সে তো' আরেক ঝামেলা! শৌচালয়ে ফরাসী দেশ থেকে এরা প্রক্ষালন যন্ত্র আমদানী করেছে ঠিকই, কিন্তু আলু-ভাজা বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ব্যাপারে বেলজিয়রা দাবী করে ফরাসীরাই ওদের এই বিশ্বজয়করা খাবারটা চুরি করেছে। সরু সরু করে আলু কেটে তেলে ভাজাটা নাকি আসলে বেলজিয়ামেই শুরু। কিন্তু কেমন করে কোন ফাঁকে যেন ফরাসীরা সেটাকে নিজের বলে দাবী করে সারা বিশ্বের সাইড-ডিশের রাজা হয়ে গেল। ইশ্‌... আমাদের বাঙালীদের আলুর ঝুড়ি ভাজাটাকে শুধু যদি প্যাকেজিং করতে পারতাম!

যাক্‌গে, বেল-জ্বী-আমে বেল-আম দেখলাম না, ব্রা-সেলস্‌-এ কিছুর সেলও পেলাম না, বুরুজে কোন বুরুজ ছিল না, আর আবুর দ্বিতীয় ভাইয়ের নাম জানতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু এটা বুঝলাম যে জাতিগত দিক থেকে বেলজিয়রা বেশ ভদ্র ও সম্মানিত। সাধে কি আর ন্যাটো-র প্রধান কার্যালয় এ শহরে অবস্থিত? আর যে দেশে টিনটিন-এর জন্ম, সেদেশটাকে আমার ভাল লাগার আর দ্বিতীয় কারণ খোঁজার দরকার নেই!

ডায়েরীর পাতা এবারের মত ফুরলো... নটে গাছটি মুড়লো!

Monday, April 23, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৬

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৬

ব্রুজ শহরটাকে বলে বেলজিয়ামের ভেনিস। ব্রাসেলস্ থেকে সড়কপথে প্রায় দু'ঘন্টা। কয়েকশ' বছরের পুরোনো এ শহরের বুকের ভেতর দিয়ে শিড়া-উপশিড়ার মত খাল চলে গেছে। তবে যা বুঝলাম, খালগুলো শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোন কাজে আসে না। পর্যটকদের নৌবিহার করিয়ে ভেনিস বা অ্যামস্টারডাম শহরের একটা আমেজ দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়। লোকসংখ্যা লাখ খানেক। পুরো শহরটাকে জাতিসঙ্ঘের ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

এখানকার চকোলেট ফ্যাক্টরীতে ঢুকে তো' মাথা খারাপ হবার জোগাড়! কত রকমের যে চকোলেট হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। আকারগুলোও বেশ মজার। অবিকল ঝিনুকের মত দেখতেও আছে, আবার হুবুহু হাতুড়ি-রেঞ্চ-নাট-বল্টুও আছে। নানান ধরণের চকোলেট ঠোঙ্গায় পুরে ওজন করে টাকা দিতে হয়। আমার এক কেজি হলো।

এখানে নৌবিহার না নিলে পুরোই মিস্। তাই সদলবলে উঠে পড়লাম একটা বড় স্পীডবোটে। ৩০ মিনিটে ১৫ কিলোমিটার ঘুড়িয়ে ৮ ইউরো নিল। শহরটা দেখে বেশ ছিমছাম মনে হলো। চালক মাইকে বিভিন্ন স্থান আর বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যে, যাদের ঘরবাড়ীর পেছন দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, তারা কতটাই না বিরক্ত হচ্ছে! প্রতিদিন কত হাজারো অচেনা মানুষ যদি আপনার বাড়ী ঘেষে যেতে থাকে আর আপনার জানালা-দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারেতে থাকে, তখন কেমন লাগবে বলুন তো'! এরা সবাই পর্যটকদের কাছে তা'দের রাইট টু প্রাইভেসি জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছে।

এরপর মধ্যাহ্নভোজের পালা। বাইরে এলে বুঝি খিদেটা একটু বেশীই লাগে। খাবারের প্রকার নিয়ে দলে নানান মুণির নানান মত। কেউ সীফুড খাবেন, তো' কেউ তন্দুরী খাবেন; কেউ আবার চাইনীজ খাবেন, কেউ বা ইটালিয়ান। অনেক খুঁজে খাঁজে এক রেস্তোঁরা পাওয়া গেল যেখানে এই সবই মিলবে। আমি অনেকদিন ধরেই মাসেলস্ খেতে চাচ্ছিলাম। এক হাঁড়ি শামুক আর দু'তিন রকম সস্ নিয়ে বসে গেলাম। এর মধ্যে একজন খরগোশের মাংস অর্ডার করেছিলেন। আমি আগে বেশ ক'বার খরগোশ খেয়েছি, তাই আর ভাগ বসালাম না। আমাদের মাঝে যারা নির্ভেজাল সাদাসিধে তন্দুরী চিকেন খাচ্ছিলেন, তাঁরা মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে আমাদের প্লেটের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর নিশ্চয়ই মনে মনে খিস্তি দিচ্ছিলেন আমাদের এসব উদ্ভট অপ্রথাগত খাবারের শখ দেখে।

ব্রুজ শহরের অলিগলি দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিলো। পাথর বাঁধানো রাস্তাগুলো ইউরোপের পুরোনো শহরগুলোর একটা বিশেষত্ব। আমাদের পুরোনো ঢাকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে এরা। আমাদের তো' সবই পীচ ঢালা রাস্তা। আর এখন তো' আবার বোধহয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার প্রচেষ্টায় ঝকঝক করছে রাস্তাগুলো!

সফরের শেষপ্রান্তে এসে গেছি। কালই ফিরবো "সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি"-তে। তবে ডায়েরীর শেষপাতা এখনও বাকি!

Saturday, April 21, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৫

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৫

বেলজিয়ান আর ইউরোপীয়দের বাংলাদেশে টাকা লগ্নি করানোর জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলাম আজ। মনভোলানো পাওয়ারপয়েন্ট দেখিয়ে, গুলিস্তান মোড়ের শিয়ালের তেল বেচা হকারের মত চাপা পিটিয়ে বোঝাবার যারপরনাই চেষ্টা করলাম যাতে তারা কালই কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। মনে হচ্ছে শিকে ছিড়বে। বাকিটা উপরওয়ালাই জানেন।

এরপর যাত্রা ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর অ্যান্টওয়ার্প-এর উদ্দেশ্যে। না, পিপীলিকার ওয়ার্প স্পীডে দৌড়ানোর কোন জায়গা না এটা ঠিকই, কিন্তু শত শত জাহাজ যখন বন্দরে ভিড়বার জন্য সাড়িবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন পিঁপড়ের লাইনের মতই দেখতে লাগে বৈকি, যেন এক্ষুনি দৌডনো শুরু করবে। যা'হোক, বন্দর কর্তৃপক্ষের ভবন দেখে তো' হা করে তাকিয়ে থাকার জোগাড়। এক পুরোনো দমকল ভবনের ওপর অত্যাধুনিক কাঁচের স্ট্রাকচার। দেখতে একটা হিরকখণ্ডের মতন। শহরটা যে হিরার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত -- এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই কাঠামো। ভেতরে দপ্তর, সিনেমা হল, রেস্তোঁরা সবই আছে। স্থপতি এক ইরাকী রমনী। এক প্রাক্তণ রাষ্ট্রদূত চাকরী ছেড়ে এই বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর কাছে শুনলাম কি করে সরকার বন্দরের সমস্ত কার্যক্রম বেসরকারী খাতে দিয়ে দূর থেকে শুধু তদারকি করে। অ্যান্টওয়ার্প শহরে নিযুক্ত বাংলাদেশের অনাররি কন্স্যুলার এক বুড়ো বেলজিয়ান। অনেকদিন ধরেই তিনি বাংলাদেশকে এখানে প্রতিনিধিত্ব করেন। 'টাউট' আর 'সে-মন' মাছ আর উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়া উইলিয়াম সমারসেট মম-এর 'লানচন' গল্পের সেই লোভনীয় অ্যাস্প্যারাগাস দিয়ে বেশ জমপেশ খানাপিনার আয়োজন করেছেন তিনি। সবাইকে আশ্বস্ত করলেন যে সবই হালাল খাবার। যদিও এই আশ্বাস আমাদের দলের কয়েকজনের মন জয় করতে পারলো না। অভুক্ত অবস্থাতেই শহর ত্যাগ করলেন তাঁরা। খুব আশা করেছিলেন, দোকানপাটে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করবেন আর 'সত্যিকরের' হালাল কিছু পেলে খিদেটা মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু শপিংমল ৬টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালি পেটেই মল ত্যাগ করতে হলো তাঁদের।

ইউরোপের এই সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়াটা শুধু বিরক্তিকরই না, অসুবিধার কারণও বটে। তারপর আবার রোববারে তো' এরা তালাই খুলবে না। অ্যামেরিকায় রোববার কেন, সপ্তাহের ৭ দিনই দোকান খোলা। ভোক্তাদের দেশ তো', তাই যেভাবে যেভাবে কাস্টামারের সুবিধা বা চাহিদা, সেভাবেই ওরা পরিষেবা দেয়। যেমন, ৩০-দিনের মানিব্যাক গ্যারান্টি, অথবা মিনিমাম প্রাইস গ্যারান্টি। এসব তো' এখানে এরা চিন্তাই করতে পারে না। সপ্তাহে সাতদিন খোলা রাখার ব্যাপারে এখানকার বন্ধুদের সাথে আমার বেশ ক'বার তর্ক হয়েছে। রস্টারিং করে যে এর সমাধান সহজেই করা যায়, এটাও বলেছি। কিন্তু লেবার ইউনিয়ন এখানে এত শক্তিশালী যে, প্রতিদিন দোকান খোলা রাখার ব্যাপারে এরা বেশ অস্বচ্ছন্দ বোধ করে।

ব্রাসেলস্-এ ফিরতে ফিরতে রাত হলো। এক দলসঙ্গী ঘোষনা দিলেন রাতের খাবারটা তিনিই খাওয়াবেন। বেলজিয়ামে সামুদ্রিক খাবারের বেশ নামডাক আছে। আমরা ক'জন মিলে জল্পনা করতে থাকলাম কোন সী-ফুড রেস্তোঁরায় যাওয়া যায়। আমাদের সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে তিনি নিয়ে গেলেন 'মহারাজা'-য় -- বেলজিয়াম দেশে পাকিস্তানীদের দ্বারা পরিচালিত ইণ্ডিয়ান খাবারের রেস্তোঁরায়।

ব্রা-সেলস্ শহরটা বক্ষবন্ধনী সেল-এর জন্য জনপ্রিয় কি না জানিনা, তবে এখানে খুব সুক্ষ্ম কাজের লেস পাওয়া যায়। বোঝাই যায়, ভালো লেসের রুমাল বা চাদর, কিংবা কাপড়-চোপড়ের দক্ষ কারিগর এখানে আছে। সাহস করে দাম জিগ্গেস করতে গিয়েছিলাম। ভয় পেয়ে মিলিটারী কায়দায় 'আবাউট-টার্ণ' করে চলে এসেছি।

কাল পাশের শহরে যাব। আপাতত: পাশ ফিরে একটু বিশ্রাম নেই যাতে ডায়েরী লিখতে ফেল না করি।

Friday, April 20, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৪

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৪

নাহ্, বেলও পাইনি, আমও মেলেনি! তবে চকলেট আর ওয়াফেল-এর দোকান আছে প্রতি রাস্তাতেই। চমৎকার আবহাওয়ার কারণে আজ ব্রাসেল্স শহরে যেন ঈদ লেগেছে। শহরের প্রধান চক গ্র্যাণ্ড প্লেস-এ দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। সদ্যপ্রস্তুত হরেক রকম চকোলেট ও নরম গরম ওয়াফেল-এর গন্ধে গ্র্যাণ্ড প্লেস ও আশেপাশের গলি সমূহ মৌ মৌ করছে। তৃতীয় রিপুর কাছে পরাজয় স্বীকার করে ঐ চকে দাঁড়িয়েই চকলেট দেওয়া ওয়াফেল খেতে খেতে লেট হয়ে গেলাম বিকেলের মিটিং-এর জন্য। লেট হলে হো'ক! ঔদরিকতার কাছে আমি সব বিসর্জন দিতে পারি! আমার ইদানিংকালের সামনে প্রসারিত উদরটি এর সাক্ষী বৈকি!

এই চকে আমার অতি প্রিয় একটা জায়গা হলো 'লা বুটিক টিনটিন'। হার্জ-এর তৈরী যে এক দুঃসাহসী তরুণ বেলজিয়ান রিপোর্টার টিনটিন আমার শৈশবকে মাতিয়ে রেখেছিল -- তাকে নিয়েই এই মিউজিয়াম ও দোকান। আয়তনে খুব একটা বড় না হলেও আমি এখানে অনেকটা সময় অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারি। স্মৃতিগুলো আমার রিওয়াইণ্ড হয়ে প্লেব্যাক হতে থাকে। আমার বাবাও টিনটিন পরতেন। মনে পড়ে, নতুন টিনটিনের কমিক হাতে আসলেই দু'জনের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

কয়েক পা হাঁটলেই রাস্তার এক কোনে রয়েছে 'মানেকেন পিস' -- ৪০০ বছর পুরনো এক উলঙ্গ বাচ্চার মুত্রত্যাগের বিশ্বখ্যাত ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। এই ঝরনা দেখার জন্য সব সময়ই ৫০-৬০ জন ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাকেজিং-এ কী না হয়! দূর দূরান্ত থেকে মানুষ পেসাব করা দেখতে আসে!

একটু রোদ উঠলেই এখানে সাধারণ মানুষগুলো ঘরছাড়া হয়ে মাঠে-ঘাটে বেড়িয়ে পড়ে। নির্মানকর্মীরাও দ্বিগুণ উৎসাহে রাস্তাঘাট মেরামতে নেমে পড়ে। আজকের ৩০ ডিগ্রীর গরমে শহরের এক চতুর্থাংশ রাস্তাই মনে হচ্ছিল মেরামত-বাহিনীর দখলে। ফলাফল ট্র্যাফিক-জ্যাম, আর তাই ট্যাক্সিতে করে হোটেল ফিরতে লেট হলো। দলের সবাই ততক্ষণে লবিতে ও ফুটপাথে অপেক্ষমান। আমি কোনমতে চুপিচুপি দলে ভিড়ে গেলাম। ভাগ্যিস ভাড়া করা বাসটা আসতে দেরী করলো। না হলে বেশ খিস্তি খেতে হতো। বাসে চড়ে শহরের কিছুটা বাইরে 'বাংলাদেশ হাউজ'-এ পৌঁছুলাম। আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাসভবন এটি। নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। কিছু ঘরোয়া বক্তৃতা (হ্যাঁ, বক্তৃতা ছাড়া আমাদের কোন শুভকাজ সম্পন্ন হয়না) শেষে যখন খেতে ডাকা হলো, মনে হচ্ছিল এই বিকেল বেলায় নৈশভোজের মানেটা কী! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভুলটা ভাঙলো। আকাশে আলো থাকলেও রাত ৯টার কাছাকাছি বাজছে! রাষ্ট্রদূত মহাদয় ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনী আপ্যায়নের কোন কমতি করেননি। টেবিলের এপার ওপার ভরা খাদ্যসমাহার। তবে একটা কথা না বললেই নয়। বিদেশে দু'দিনের জন্য বেড়াতে এসে যদি আবার সেই পোলাও-কোর্মা, ডাল-ভাতই খেতে হয়, তা'হলে ঠিক ব্যাপারটা জমে না। এ জিনিসটা প্রতিবারই হয়। যখনই বিদেশে কোন দেশী মানুষ তা'র বাড়ীতে ডেকে খাওয়ান, তখন তাঁরা দেশী খাবারই পরিবেশন করেন। আরে ভাই, আপনার আতিথেয়তায় আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এ খাবার তো আমি রোজ বাংলাদেশে বসেই খাই। বিদেশী কিছু, নতুন কিছু খাওয়ান না! আপনার হয়তো রোজ রোজ ঘন ডাল কিংবা চাটনী খাওয়া হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমরা যারা দেশে থাকি, আমাদের কাছে এতো আটপৌরে।

কাল সকালে বিদেশীদের সামনে বাংলাদেশের আইটি ব্যবসায়ের সম্ভাবনা সমূহ তুলে ধরার গুরু দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। পারবো তো' প্যাকেজিংটা ভালো করে করতে?


Thursday, April 19, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৩

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৩

হোটেলে এসে নরম বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে আবারও লেখা শুরু করলাম। বিমানবন্দরে আমার দলের লোকজনদের পেয়ে গিয়েছিলাম। তাঁরা এক কাতারে কাতার এয়ারওয়েজে চেপে কাতার হয়ে মোটামুটি একই সময়ে পৌঁছিয়েছিলেন। অভিবাসনের অগ্নিপরীক্ষার জন্য লম্বা কাতারে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন সবাই কাতর, তখন তারই মাঝে একজনকে নিয়ে বেশ এক কাণ্ড ঘটে গেল। পরিবারসহ উনি এসেছেন মিটিং কাম মধুচন্দ্রিমায়। পরিবারের ভ্যানিটি ব্যাগটি তল্লাশি করে শুল্ক-বিভাগ এক কাড়ি টাকা উদ্ধার করে বসলো। শখ করে শপিং করার জন্য পরিবার টাকাগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। যা'হোক অনেক দেন দরবার করে ৭৫০ ইউরো জরিমানা দিয়ে তাঁরা এযাত্রা পার পেলেন।

এদেশটার নাম 'বেল-জ্বী-আম' কেন হলো, এটা বুঝতে চাই। ভালো বেল বা ভালো আম কি পাওয়া যায় এদেশে? গেল বছর একদিনের জন্য এসেছিলাম এখানে। তখন তো' চকোলেট আর আইসক্রীম ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বেল আর আমের খোঁজে বেড়োবো এখনই।

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ২

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ২

অবশেষে পৌঁছুলাম ব্রাসেলস্ বিমানবন্দরে। নেমেই ধাক্কা! আধ-কিলোমিটার লম্বা লাইন অভিবাসন জানালার সামনে! নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল, কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই যখন পেছনে তাকিয়ে দেখলাম যে অন্তত শ' খানেক লোক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, মনটা তখন একটু ভালো হয়ে গেল। যাক্, আমার চেয়েও 'বোকা' মানুষ আছে তা'হলে। আসলে এরা সত্যিই বোকা। আমাদের দেশী মানুষগুলোর মতো চালাক হলে কখন শর্টকাট মেরে, ঠেলাঠেলি করে সামনে চলে যেত! ...যাক, আপাতত: এই বোকাদের সাথেই দাঁড়িয়ে আছি। লাইনটা দ্রুত ছোট হয়ে আসছে। দেখা যাক, শহরের মুখ কখন দেখতে পাই।

Wednesday, April 18, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ১

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ১

মধ্যরাতে "আবু দু'ভাই"-এ যাত্রা-বিরতি। এক ভাইয়ের নাম তো বুঝলাম আবু, অন্য ভাইয়ের নামটা কী? ...আকাশ থেকে বিমানের জানালা দিয়ে এই মরুর দেশটাকে কিছুটা আঁচ করার চেষ্টা করছিলাম। যা বুঝলাম তা' হলো "দু'ভাই"-এর কাছাকাছি এরা যেতে পারেনি এখনও, যদিও এই আবু-ই আমিরাত-গুলোর নেতা। বিমানবন্দরটাতেও ঠিক বড়লোকি ভাবটা নেই। একটু বাইরে যেতে পারলে মন্দ হতো না!

Thursday, January 25, 2018


ব্লকচেইন প্রযুক্তি

সৈয়দ আলমাস কবীর, সভাপতি, বেসিস

ব্লকচেইন আধুনিককালের এক অভিনব দ্ভাবন! সাতোশী নাকামতো’ ছদ্মনামের এক বা একাধিক ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক। ২০০৯-এ প্রথমবারের মত বিটকয়েন সফ্‌টওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক বিবর্তন ঘটেছে। তথ্যকে ডিজিটালরূপে বণ্টন করা (অনুলিপি নয়) এই ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি এক নতুন ধরনের ইন্টারনেটের অবতারণা করেছে যদিও মূলত ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্য এই ব্লকচেইন-এর উদ্ভাবন হয়েছিল, কিন্তু এখন এই প্রযুক্তির অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যবহারের সন্ধান চলছে।

ব্লকচেইন হলো একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন কিছুরই কার্য্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বণ্টিত ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলির মধ্যে সাধিত সকল লেনদেনের নথী রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোন তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা’ থেকে যায় এবং কখনও মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এই অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে

একটি স্প্রেডশীটটি চিন্তা করুন যা পুরো নেটওয়ার্ক জুড়ে কয়েক হাজার বার ডুপ্লিকেট করা হয়েছে। তারপর কল্পনা করুন যে এই নেটওয়ার্কে এই স্প্রেডশীটটিকে নিয়মিতভাবে আপডেট করা হচ্ছে, এবং যে ভার্শনটি সংখ্যায় বেশী থাকে, ব্যবহারকারীরা সেটাই দেখতে পাচ্ছে উইকিপিডিয়া-র ডিজিটাল ব্যাকবোন সরকারী, ব্যাংক বা বীমা কোম্পানীর সুরক্ষিত এবং কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ-এর অনুরূপ। কেন্দ্রীভূত ডেটাবেজগুলির প্রবেশাধিকার এবং সুরক্ষা ব্যবস্থাপনাসহ সকল নিয়ন্ত্রণ যার যার মালিকদের কাছে থাকে। কিন্তু ব্লকচেইন প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত বণ্টিত ডাটাবেজ-এর ব্যাকবোন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটিই ব্লকচেইন প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

যেহেতু ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল তথ্যসমূহের নিরাপত্তার সাথে আপোষ না করেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিজিটাল তথ্য যাচাই করা যায়, সেহেতু এটি প্রয়োগ করে ডিজিটাল বিশ্বে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। ব্লকচেইন প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো ‘স্মার্ট কন্ট্রাক্ট’এটি মূলতঃ একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি চুক্তির শর্তাবলী সম্পাদন করতে পারে আরেকটি নির্ভরযোগ্য প্রয়োগ হলো এই স্মার্ট চুক্তি ব্যবহার করে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ, যাকে ‘স্মার্ট প্রপার্টি’ বলা হয়।

ব্লকচেইন প্রযুক্তির ডাটাবেজ বণ্টিত ও সর্বজনীনএটা কোন একক জায়গায় অবস্থান করে না বা সংরক্ষণ করা হয় না অর্থাৎ, এতে যে রেকর্ডগুলি থাকে তা সত্যিকার অর্থেই পাবলিক এবং সহজেই যাচাইযোগ্য। কোন কেন্দ্রীয় সংস্করণ না থাকার ফলে এটা হ্যাকিং-এর ঝুঁকি থেকেও মুক্ত। আগেই বলেছি যে, ব্লকচেইন ডাটাবেজ সংখ্যাগড়িষ্ঠতার উপর নির্ভর করে কাজ করে। একইসাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতি দশ মিনিট অন্তর এটি প্রত্যেকটি লেনদেন যাচাই করতে থাকে। এই লেনদেনগুলিকে এক একটি ব্লক বলা হয়। অর্থাৎ, কোন একটি অংশের তথ্য পরিবর্তন করে ডাটাবেজ-এর অখণ্ডতা বা বিশুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না। এর ফলে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। একাধিক সার্ভারে এই ডাটাবেজ ব্লক আকারে থাকায় এখানে কোন একক পয়েন্ট অফ ফেলিউরও নেই।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রিত হওয়ায় অনেক অনুক্রমিক কাজ একসাথে হয়ে যায়। যেমন, এ প্রযুক্তি ব্যবহারে শেয়ার-বাজারের লেনদেন যুগপতভাবে হতে পারে; কিংবা, ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডকে জনসাধারণের জন্য অনেক সহজলভ্য করা যেতে পারে। ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ ই-গভার্নেন্স চালু করার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজন ক্লাউড-কম্পিয়ুটিং প্ল্যাটফর্ম। মহারাষ্ট্র সরকার বলেছেন যে, তাঁরা পাবলিক ক্লাউড ব্যবহার করবেন যা ২ বিলিয়ন ডলারের বাজার সৃষ্টি করবে এবং একই সাথে সরকারের সমস্ত তথ্য ক্লাউডে স্থানান্তরিত হওয়ায় সরকারের প্রচুর পরিমান অর্থ সাশ্রয় হবে। ব্লকচেইন ব্যবহারের কারণে তথ্যের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা তো থাকবেই।
বাংলাদেশেও এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে। তবে, সবার আগে মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা যদি কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মানসিকতা ছাড়তে না পারি, তা’হলে এ প্রযুক্তি কাজ করবে না। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর একটি প্রধান ঊদ্দেশ্য স্বচ্ছতা। তাই সরকারকেও বিকেন্দ্রিত ও বণ্টিত তথ্য-ভাণ্ডার সম্মন্ধে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করতে হবে। নতুন প্রযুক্তির সাথে যদি আমরা এখনই নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারি, তা’হলে আমরা হয়তো এগোবো ঠিকই, কিন্তু অন্যরা আমাদের থেকে অনেক বেশী এগিয়ে যাবে।
Published in প্রথম আলো
https://goo.gl/ZTgGvY