Saturday, April 21, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৫

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৫

বেলজিয়ান আর ইউরোপীয়দের বাংলাদেশে টাকা লগ্নি করানোর জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলাম আজ। মনভোলানো পাওয়ারপয়েন্ট দেখিয়ে, গুলিস্তান মোড়ের শিয়ালের তেল বেচা হকারের মত চাপা পিটিয়ে বোঝাবার যারপরনাই চেষ্টা করলাম যাতে তারা কালই কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। মনে হচ্ছে শিকে ছিড়বে। বাকিটা উপরওয়ালাই জানেন।

এরপর যাত্রা ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর অ্যান্টওয়ার্প-এর উদ্দেশ্যে। না, পিপীলিকার ওয়ার্প স্পীডে দৌড়ানোর কোন জায়গা না এটা ঠিকই, কিন্তু শত শত জাহাজ যখন বন্দরে ভিড়বার জন্য সাড়িবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন পিঁপড়ের লাইনের মতই দেখতে লাগে বৈকি, যেন এক্ষুনি দৌডনো শুরু করবে। যা'হোক, বন্দর কর্তৃপক্ষের ভবন দেখে তো' হা করে তাকিয়ে থাকার জোগাড়। এক পুরোনো দমকল ভবনের ওপর অত্যাধুনিক কাঁচের স্ট্রাকচার। দেখতে একটা হিরকখণ্ডের মতন। শহরটা যে হিরার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত -- এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই কাঠামো। ভেতরে দপ্তর, সিনেমা হল, রেস্তোঁরা সবই আছে। স্থপতি এক ইরাকী রমনী। এক প্রাক্তণ রাষ্ট্রদূত চাকরী ছেড়ে এই বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর কাছে শুনলাম কি করে সরকার বন্দরের সমস্ত কার্যক্রম বেসরকারী খাতে দিয়ে দূর থেকে শুধু তদারকি করে। অ্যান্টওয়ার্প শহরে নিযুক্ত বাংলাদেশের অনাররি কন্স্যুলার এক বুড়ো বেলজিয়ান। অনেকদিন ধরেই তিনি বাংলাদেশকে এখানে প্রতিনিধিত্ব করেন। 'টাউট' আর 'সে-মন' মাছ আর উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়া উইলিয়াম সমারসেট মম-এর 'লানচন' গল্পের সেই লোভনীয় অ্যাস্প্যারাগাস দিয়ে বেশ জমপেশ খানাপিনার আয়োজন করেছেন তিনি। সবাইকে আশ্বস্ত করলেন যে সবই হালাল খাবার। যদিও এই আশ্বাস আমাদের দলের কয়েকজনের মন জয় করতে পারলো না। অভুক্ত অবস্থাতেই শহর ত্যাগ করলেন তাঁরা। খুব আশা করেছিলেন, দোকানপাটে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করবেন আর 'সত্যিকরের' হালাল কিছু পেলে খিদেটা মিটিয়ে ফেলবেন। কিন্তু শপিংমল ৬টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খালি পেটেই মল ত্যাগ করতে হলো তাঁদের।

ইউরোপের এই সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়াটা শুধু বিরক্তিকরই না, অসুবিধার কারণও বটে। তারপর আবার রোববারে তো' এরা তালাই খুলবে না। অ্যামেরিকায় রোববার কেন, সপ্তাহের ৭ দিনই দোকান খোলা। ভোক্তাদের দেশ তো', তাই যেভাবে যেভাবে কাস্টামারের সুবিধা বা চাহিদা, সেভাবেই ওরা পরিষেবা দেয়। যেমন, ৩০-দিনের মানিব্যাক গ্যারান্টি, অথবা মিনিমাম প্রাইস গ্যারান্টি। এসব তো' এখানে এরা চিন্তাই করতে পারে না। সপ্তাহে সাতদিন খোলা রাখার ব্যাপারে এখানকার বন্ধুদের সাথে আমার বেশ ক'বার তর্ক হয়েছে। রস্টারিং করে যে এর সমাধান সহজেই করা যায়, এটাও বলেছি। কিন্তু লেবার ইউনিয়ন এখানে এত শক্তিশালী যে, প্রতিদিন দোকান খোলা রাখার ব্যাপারে এরা বেশ অস্বচ্ছন্দ বোধ করে।

ব্রাসেলস্-এ ফিরতে ফিরতে রাত হলো। এক দলসঙ্গী ঘোষনা দিলেন রাতের খাবারটা তিনিই খাওয়াবেন। বেলজিয়ামে সামুদ্রিক খাবারের বেশ নামডাক আছে। আমরা ক'জন মিলে জল্পনা করতে থাকলাম কোন সী-ফুড রেস্তোঁরায় যাওয়া যায়। আমাদের সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে তিনি নিয়ে গেলেন 'মহারাজা'-য় -- বেলজিয়াম দেশে পাকিস্তানীদের দ্বারা পরিচালিত ইণ্ডিয়ান খাবারের রেস্তোঁরায়।

ব্রা-সেলস্ শহরটা বক্ষবন্ধনী সেল-এর জন্য জনপ্রিয় কি না জানিনা, তবে এখানে খুব সুক্ষ্ম কাজের লেস পাওয়া যায়। বোঝাই যায়, ভালো লেসের রুমাল বা চাদর, কিংবা কাপড়-চোপড়ের দক্ষ কারিগর এখানে আছে। সাহস করে দাম জিগ্গেস করতে গিয়েছিলাম। ভয় পেয়ে মিলিটারী কায়দায় 'আবাউট-টার্ণ' করে চলে এসেছি।

কাল পাশের শহরে যাব। আপাতত: পাশ ফিরে একটু বিশ্রাম নেই যাতে ডায়েরী লিখতে ফেল না করি।

No comments: