বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৬
ব্রুজ শহরটাকে বলে বেলজিয়ামের ভেনিস। ব্রাসেলস্ থেকে সড়কপথে প্রায় দু'ঘন্টা। কয়েকশ' বছরের পুরোনো এ শহরের বুকের ভেতর দিয়ে শিড়া-উপশিড়ার মত খাল চলে গেছে। তবে যা বুঝলাম, খালগুলো শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোন কাজে আসে না। পর্যটকদের নৌবিহার করিয়ে ভেনিস বা অ্যামস্টারডাম শহরের একটা আমেজ দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়। লোকসংখ্যা লাখ খানেক। পুরো শহরটাকে জাতিসঙ্ঘের ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
এখানকার চকোলেট ফ্যাক্টরীতে ঢুকে তো' মাথা খারাপ হবার জোগাড়! কত রকমের যে চকোলেট হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। আকারগুলোও বেশ মজার। অবিকল ঝিনুকের মত দেখতেও আছে, আবার হুবুহু হাতুড়ি-রেঞ্চ-নাট-বল্টুও আছে। নানান ধরণের চকোলেট ঠোঙ্গায় পুরে ওজন করে টাকা দিতে হয়। আমার এক কেজি হলো।
এখানে নৌবিহার না নিলে পুরোই মিস্। তাই সদলবলে উঠে পড়লাম একটা বড় স্পীডবোটে। ৩০ মিনিটে ১৫ কিলোমিটার ঘুড়িয়ে ৮ ইউরো নিল। শহরটা দেখে বেশ ছিমছাম মনে হলো। চালক মাইকে বিভিন্ন স্থান আর বাড়ীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যে, যাদের ঘরবাড়ীর পেছন দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, তারা কতটাই না বিরক্ত হচ্ছে! প্রতিদিন কত হাজারো অচেনা মানুষ যদি আপনার বাড়ী ঘেষে যেতে থাকে আর আপনার জানালা-দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারেতে থাকে, তখন কেমন লাগবে বলুন তো'! এরা সবাই পর্যটকদের কাছে তা'দের রাইট টু প্রাইভেসি জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছে।
এরপর মধ্যাহ্নভোজের পালা। বাইরে এলে বুঝি খিদেটা একটু বেশীই লাগে। খাবারের প্রকার নিয়ে দলে নানান মুণির নানান মত। কেউ সীফুড খাবেন, তো' কেউ তন্দুরী খাবেন; কেউ আবার চাইনীজ খাবেন, কেউ বা ইটালিয়ান। অনেক খুঁজে খাঁজে এক রেস্তোঁরা পাওয়া গেল যেখানে এই সবই মিলবে। আমি অনেকদিন ধরেই মাসেলস্ খেতে চাচ্ছিলাম। এক হাঁড়ি শামুক আর দু'তিন রকম সস্ নিয়ে বসে গেলাম। এর মধ্যে একজন খরগোশের মাংস অর্ডার করেছিলেন। আমি আগে বেশ ক'বার খরগোশ খেয়েছি, তাই আর ভাগ বসালাম না। আমাদের মাঝে যারা নির্ভেজাল সাদাসিধে তন্দুরী চিকেন খাচ্ছিলেন, তাঁরা মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে আমাদের প্লেটের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর নিশ্চয়ই মনে মনে খিস্তি দিচ্ছিলেন আমাদের এসব উদ্ভট অপ্রথাগত খাবারের শখ দেখে।
ব্রুজ শহরের অলিগলি দিয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিলো। পাথর বাঁধানো রাস্তাগুলো ইউরোপের পুরোনো শহরগুলোর একটা বিশেষত্ব। আমাদের পুরোনো ঢাকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে এরা। আমাদের তো' সবই পীচ ঢালা রাস্তা। আর এখন তো' আবার বোধহয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করার প্রচেষ্টায় ঝকঝক করছে রাস্তাগুলো!
সফরের শেষপ্রান্তে এসে গেছি। কালই ফিরবো "সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি"-তে। তবে ডায়েরীর শেষপাতা এখনও বাকি!
No comments:
Post a Comment