Friday, April 20, 2018

বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৪

 বেলজিয়াম-যাত্রীর ডায়েরী - পর্ব ৪

নাহ্, বেলও পাইনি, আমও মেলেনি! তবে চকলেট আর ওয়াফেল-এর দোকান আছে প্রতি রাস্তাতেই। চমৎকার আবহাওয়ার কারণে আজ ব্রাসেল্স শহরে যেন ঈদ লেগেছে। শহরের প্রধান চক গ্র্যাণ্ড প্লেস-এ দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়। সদ্যপ্রস্তুত হরেক রকম চকোলেট ও নরম গরম ওয়াফেল-এর গন্ধে গ্র্যাণ্ড প্লেস ও আশেপাশের গলি সমূহ মৌ মৌ করছে। তৃতীয় রিপুর কাছে পরাজয় স্বীকার করে ঐ চকে দাঁড়িয়েই চকলেট দেওয়া ওয়াফেল খেতে খেতে লেট হয়ে গেলাম বিকেলের মিটিং-এর জন্য। লেট হলে হো'ক! ঔদরিকতার কাছে আমি সব বিসর্জন দিতে পারি! আমার ইদানিংকালের সামনে প্রসারিত উদরটি এর সাক্ষী বৈকি!

এই চকে আমার অতি প্রিয় একটা জায়গা হলো 'লা বুটিক টিনটিন'। হার্জ-এর তৈরী যে এক দুঃসাহসী তরুণ বেলজিয়ান রিপোর্টার টিনটিন আমার শৈশবকে মাতিয়ে রেখেছিল -- তাকে নিয়েই এই মিউজিয়াম ও দোকান। আয়তনে খুব একটা বড় না হলেও আমি এখানে অনেকটা সময় অনায়াসেই কাটিয়ে দিতে পারি। স্মৃতিগুলো আমার রিওয়াইণ্ড হয়ে প্লেব্যাক হতে থাকে। আমার বাবাও টিনটিন পরতেন। মনে পড়ে, নতুন টিনটিনের কমিক হাতে আসলেই দু'জনের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।

কয়েক পা হাঁটলেই রাস্তার এক কোনে রয়েছে 'মানেকেন পিস' -- ৪০০ বছর পুরনো এক উলঙ্গ বাচ্চার মুত্রত্যাগের বিশ্বখ্যাত ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। এই ঝরনা দেখার জন্য সব সময়ই ৫০-৬০ জন ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাকেজিং-এ কী না হয়! দূর দূরান্ত থেকে মানুষ পেসাব করা দেখতে আসে!

একটু রোদ উঠলেই এখানে সাধারণ মানুষগুলো ঘরছাড়া হয়ে মাঠে-ঘাটে বেড়িয়ে পড়ে। নির্মানকর্মীরাও দ্বিগুণ উৎসাহে রাস্তাঘাট মেরামতে নেমে পড়ে। আজকের ৩০ ডিগ্রীর গরমে শহরের এক চতুর্থাংশ রাস্তাই মনে হচ্ছিল মেরামত-বাহিনীর দখলে। ফলাফল ট্র্যাফিক-জ্যাম, আর তাই ট্যাক্সিতে করে হোটেল ফিরতে লেট হলো। দলের সবাই ততক্ষণে লবিতে ও ফুটপাথে অপেক্ষমান। আমি কোনমতে চুপিচুপি দলে ভিড়ে গেলাম। ভাগ্যিস ভাড়া করা বাসটা আসতে দেরী করলো। না হলে বেশ খিস্তি খেতে হতো। বাসে চড়ে শহরের কিছুটা বাইরে 'বাংলাদেশ হাউজ'-এ পৌঁছুলাম। আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাসভবন এটি। নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি। কিছু ঘরোয়া বক্তৃতা (হ্যাঁ, বক্তৃতা ছাড়া আমাদের কোন শুভকাজ সম্পন্ন হয়না) শেষে যখন খেতে ডাকা হলো, মনে হচ্ছিল এই বিকেল বেলায় নৈশভোজের মানেটা কী! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভুলটা ভাঙলো। আকাশে আলো থাকলেও রাত ৯টার কাছাকাছি বাজছে! রাষ্ট্রদূত মহাদয় ও তাঁর অর্ধাঙ্গিনী আপ্যায়নের কোন কমতি করেননি। টেবিলের এপার ওপার ভরা খাদ্যসমাহার। তবে একটা কথা না বললেই নয়। বিদেশে দু'দিনের জন্য বেড়াতে এসে যদি আবার সেই পোলাও-কোর্মা, ডাল-ভাতই খেতে হয়, তা'হলে ঠিক ব্যাপারটা জমে না। এ জিনিসটা প্রতিবারই হয়। যখনই বিদেশে কোন দেশী মানুষ তা'র বাড়ীতে ডেকে খাওয়ান, তখন তাঁরা দেশী খাবারই পরিবেশন করেন। আরে ভাই, আপনার আতিথেয়তায় আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু এ খাবার তো আমি রোজ বাংলাদেশে বসেই খাই। বিদেশী কিছু, নতুন কিছু খাওয়ান না! আপনার হয়তো রোজ রোজ ঘন ডাল কিংবা চাটনী খাওয়া হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমরা যারা দেশে থাকি, আমাদের কাছে এতো আটপৌরে।

কাল সকালে বিদেশীদের সামনে বাংলাদেশের আইটি ব্যবসায়ের সম্ভাবনা সমূহ তুলে ধরার গুরু দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে। পারবো তো' প্যাকেজিংটা ভালো করে করতে?


No comments: