Thursday, January 25, 2018


ব্লকচেইন প্রযুক্তি

সৈয়দ আলমাস কবীর, সভাপতি, বেসিস

ব্লকচেইন আধুনিককালের এক অভিনব দ্ভাবন! সাতোশী নাকামতো’ ছদ্মনামের এক বা একাধিক ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক। ২০০৯-এ প্রথমবারের মত বিটকয়েন সফ্‌টওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক বিবর্তন ঘটেছে। তথ্যকে ডিজিটালরূপে বণ্টন করা (অনুলিপি নয়) এই ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি এক নতুন ধরনের ইন্টারনেটের অবতারণা করেছে যদিও মূলত ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্য এই ব্লকচেইন-এর উদ্ভাবন হয়েছিল, কিন্তু এখন এই প্রযুক্তির অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যবহারের সন্ধান চলছে।

ব্লকচেইন হলো একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন কিছুরই কার্য্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বণ্টিত ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলির মধ্যে সাধিত সকল লেনদেনের নথী রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোন তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা’ থেকে যায় এবং কখনও মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এই অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে

একটি স্প্রেডশীটটি চিন্তা করুন যা পুরো নেটওয়ার্ক জুড়ে কয়েক হাজার বার ডুপ্লিকেট করা হয়েছে। তারপর কল্পনা করুন যে এই নেটওয়ার্কে এই স্প্রেডশীটটিকে নিয়মিতভাবে আপডেট করা হচ্ছে, এবং যে ভার্শনটি সংখ্যায় বেশী থাকে, ব্যবহারকারীরা সেটাই দেখতে পাচ্ছে উইকিপিডিয়া-র ডিজিটাল ব্যাকবোন সরকারী, ব্যাংক বা বীমা কোম্পানীর সুরক্ষিত এবং কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ-এর অনুরূপ। কেন্দ্রীভূত ডেটাবেজগুলির প্রবেশাধিকার এবং সুরক্ষা ব্যবস্থাপনাসহ সকল নিয়ন্ত্রণ যার যার মালিকদের কাছে থাকে। কিন্তু ব্লকচেইন প্রযুক্তি দ্বারা নির্মিত বণ্টিত ডাটাবেজ-এর ব্যাকবোন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটিই ব্লকচেইন প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

যেহেতু ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল তথ্যসমূহের নিরাপত্তার সাথে আপোষ না করেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিজিটাল তথ্য যাচাই করা যায়, সেহেতু এটি প্রয়োগ করে ডিজিটাল বিশ্বে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। ব্লকচেইন প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো ‘স্মার্ট কন্ট্রাক্ট’এটি মূলতঃ একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি চুক্তির শর্তাবলী সম্পাদন করতে পারে আরেকটি নির্ভরযোগ্য প্রয়োগ হলো এই স্মার্ট চুক্তি ব্যবহার করে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ, যাকে ‘স্মার্ট প্রপার্টি’ বলা হয়।

ব্লকচেইন প্রযুক্তির ডাটাবেজ বণ্টিত ও সর্বজনীনএটা কোন একক জায়গায় অবস্থান করে না বা সংরক্ষণ করা হয় না অর্থাৎ, এতে যে রেকর্ডগুলি থাকে তা সত্যিকার অর্থেই পাবলিক এবং সহজেই যাচাইযোগ্য। কোন কেন্দ্রীয় সংস্করণ না থাকার ফলে এটা হ্যাকিং-এর ঝুঁকি থেকেও মুক্ত। আগেই বলেছি যে, ব্লকচেইন ডাটাবেজ সংখ্যাগড়িষ্ঠতার উপর নির্ভর করে কাজ করে। একইসাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতি দশ মিনিট অন্তর এটি প্রত্যেকটি লেনদেন যাচাই করতে থাকে। এই লেনদেনগুলিকে এক একটি ব্লক বলা হয়। অর্থাৎ, কোন একটি অংশের তথ্য পরিবর্তন করে ডাটাবেজ-এর অখণ্ডতা বা বিশুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না। এর ফলে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। একাধিক সার্ভারে এই ডাটাবেজ ব্লক আকারে থাকায় এখানে কোন একক পয়েন্ট অফ ফেলিউরও নেই।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রিত হওয়ায় অনেক অনুক্রমিক কাজ একসাথে হয়ে যায়। যেমন, এ প্রযুক্তি ব্যবহারে শেয়ার-বাজারের লেনদেন যুগপতভাবে হতে পারে; কিংবা, ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডকে জনসাধারণের জন্য অনেক সহজলভ্য করা যেতে পারে। ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ ই-গভার্নেন্স চালু করার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজন ক্লাউড-কম্পিয়ুটিং প্ল্যাটফর্ম। মহারাষ্ট্র সরকার বলেছেন যে, তাঁরা পাবলিক ক্লাউড ব্যবহার করবেন যা ২ বিলিয়ন ডলারের বাজার সৃষ্টি করবে এবং একই সাথে সরকারের সমস্ত তথ্য ক্লাউডে স্থানান্তরিত হওয়ায় সরকারের প্রচুর পরিমান অর্থ সাশ্রয় হবে। ব্লকচেইন ব্যবহারের কারণে তথ্যের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা তো থাকবেই।
বাংলাদেশেও এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে। তবে, সবার আগে মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা যদি কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মানসিকতা ছাড়তে না পারি, তা’হলে এ প্রযুক্তি কাজ করবে না। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর একটি প্রধান ঊদ্দেশ্য স্বচ্ছতা। তাই সরকারকেও বিকেন্দ্রিত ও বণ্টিত তথ্য-ভাণ্ডার সম্মন্ধে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করতে হবে। নতুন প্রযুক্তির সাথে যদি আমরা এখনই নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারি, তা’হলে আমরা হয়তো এগোবো ঠিকই, কিন্তু অন্যরা আমাদের থেকে অনেক বেশী এগিয়ে যাবে।
Published in প্রথম আলো
https://goo.gl/ZTgGvY

No comments: