Sunday, February 16, 2020

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ৪

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ৪ঃ

শীতের দেশে ভোরবেলা শয্যাত্যাগ যে কতবড় একটা চ্যালেঞ্জ, সেটা লিখে বোঝানো আমার কম্ম নয়। প্রণোদনা একটাই, তা’ হলো মেরুর বরফের পাহাড়ে উঠে বল্গাহরিণ-টানা স্লেজগাড়ীতে চড়া। অতঃপর হোটেলের হরেক পদ-সম্বলিত প্রাতঃরাশ শেষ করে বাসে চড়ে বসলাম। এক ঘন্টা দূরে এক পাহাড়ের উপর রয়েছে সামি উপজাতিদের একটি গ্রাম; সেখানে তা’দের প্রধান জীবিকা হলো পশুপালন। বল্গাহরিণ এখানকার প্রধান গবাদি পশু। এই পশুপালনের পাশাপাশি বল্গাহরিণের আর তা’দের জীবনযাত্রার উপর নির্ভর করে একটা পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের আকর্ষিত করার জন্য বল্গাহরিণ-টানা স্লেজগাড়ীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এখানে।















সামি-দের বরফ-ঢাকা গ্রামে যখন পৌঁছুলাম, আকাশ তখন ঝলমলে। একটা বিশালাকায় শঙ্কুসদৃশ তাবুতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। তাবুর ভেতর ঠিক মাঝখানে আগুন জ্বালানো আছে। তা’র চারিদিক ঘিরে আছে বসার বেঞ্চি। বেঞ্চির ওপর ঠাণ্ডা প্রতিরোধক হিসেবে বিছানো আছে বল্গাহরিণের চামড়া। আমাদেরকে বেঞ্চিতে বসিয়ে স্বাগতম জানালো সামিদের পক্ষ থেকে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। আমাদের বলা হলো স্লেজগাড়ীতে কি করে বসতে হবে, কী কী করা যাবে আর যাবে না, ইত্যাদি। জোরে শব্দ করলে বা হঠাৎ করে অঙ্গভঙ্গি করলে হরিণরা ভয় পেয়ে দৌড় দিতে পারে, এ বলে সাবধান করে দেওয়া হলো আমাদের। আমরা যাদের কাছে এসেছি, এদের পালে আছে তিনশ’ বল্গাহরিণ। এগুলো সবগুলিই বন্য। কিন্তু বছরের এ সময়টাতে এদেরকে সমতল উপত্যকায় নিয়ে এসে বেড়া দিয়ে রাখা হয়। তখন এরা গৃহপালিতের মতই আচরণ করে। কিন্তু, যখনই আবার এদেরকে পাহাড়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখনই এদের সহজাত প্রবৃত্তি ফিরে আসে চট্‌ করে, এবং আবার সহজেই এরা মুক্ত বন্য পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। আমরা দু’জন করে একেকটি স্লেজগাড়ীতে বসলাম। স্লেজ হলো মসৃণ কাঠের তৈরী পাটাতনওয়ালা লম্বা আরামকেদারার মত বিশেষ গাড়ী, যাকে বরফের উপর দিয়ে সহজেই টেনে নিয়ে নেওয়া যায়। বরফের দেশে পরিবহনের জন্য এই স্লেজগাড়ী খুব জনপ্রিয়। একেক দেশে একেকভাবে স্লেজ টানা হয়। এই বল্গাহরিণের দেশে হরিণরাই স্লেজ টানে। আমাদের গাড়ীটির সামনে যেটি বাঁধা আছে, সেটি মোটামুটি মাঝারী আকারের। মর্দ, তবে শিঙ পড়ে গেছে সদ্য। বছরে এরা একবার করে শিঙ বদলায়। যখন নতুন করে শিঙ গজায়, মখমলের একটা আবরণ থাকে এই শিঙের উপর। বড় হলে এই আবরণটি ঝরে যায়। খুব দ্রুতই শিঙগুলো বড় হয়; ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে একেকটা। প্রায় ১৫ কেজি পর্যন্ত এই একেক শিঙের ওজন বহন করার জন্য যথেষ্ট বলবান হয়ে থাকে এই ব্লগাহরিণগুলো। তাই আমাদের দু’জনকে টেনে নিয়ে যেতে মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না এই তুষারপ্রাণীটির। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা বরফঢাকা পাহাড়ের উপর দিয়ে স্লেজে চেপে প্রকৃতিটাকে দেখলাম, মেরুদেশের নৈসর্গিক পরিবেশটাকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। ফিরে আসার পর তাবুতে জড় হলাম আবার। এক সামি মহিলা আমাদের আপ্যায়ন করলেন হরিণ-মাংসের স্যূপ দিয়ে। সামি জীবনযাত্রার কথা শোনালেন আমাদের। পৃথিবীতে প্রায় দেড় লাখ সামি উপজাতীয়দের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার আছে নরওয়েতে। বাকিরা আছে সুইডেন ও ফিনল্যাণ্ডে। এছাড়াও হাতে গোণা কিছু সামি বাস করে রাশিয়া, আমেরিকা ও ইউক্রেণে। এদের বিশেষ ধরণের কাপড় ও আনুষঙ্গিক উপকরণ, তৈজসপত্র ইত্যাদি দেখলাম আমরা। নরওয়েতে একসময়ে আইন করে সামি সভ্যতাকে ধংস করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। নিয়ম করে স্কুল থেকে সামি ভাষার চর্চা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে আবার এই কৃষ্টি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পশুপালন ও মাছ ধরাই সামিদের প্রধান জীবিকা। এছাড়াও কিছু সামি খণিতে কাজ করে বা কাঠুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

সামি-গ্রাম থেকে বাসে করে আবার ফিরে এলাম হোটেলে। রেইনডিয়ার-এর মাংসের স্যূপ খেয়ে পেট ভরাই ছিল; তাই আর মধ্যাহ্নভোজের প্রয়োজন হলো না। হোটেলের কামরায় কিছুটা সময় গড়িয়ে নিয়ে, বিকেলে পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরুলাম। রাতে যাবো সুমেরুর প্রধান আকর্ষণ মেরুপ্রভা দেখতে। ট্রম্‌সৌ শহরটা বেশ সাজানো-গোছানো। দৃষ্টিনন্দন একটা টাউন-স্কোয়ার বা শহরকেন্দ্র আছে, যার মাঝখানে আছে একটি গীর্জা। চারিপাশে আছে সারি সারি হাল-ফ্যাশনের দোকানপাট। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর বেশীভাগই হয় পর্যটন ব্যবসায়ী, নয়তো নিদর্শন স্মারক বিক্রেতা, অথবা বহিরঙ্গন ক্রীড়া-বিষয়ক সরঞ্জাম ব্যাপারী। এটা যে একটা পর্যটনের শহর, তা’ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। পর্যটনের প্রধান কারণ হলো, অরোরা বোরালিস বা মেরুপ্রভা।

অরোরা বোরালিস হলো সুমেরু অঞ্চলের আকাশে দৃশ্যমান বর্ণিল মনোরম আলোকচ্ছটা। এক সময় একে অতিপ্রাকৃতিক বলে বিবেচনা করা হতো। অনেক আদিবাসিরা মনে করতো, তা’দের পূর্বপুরুষদের আত্মা আলোকরাজি হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে আকাশে। আবার কেউ বা মনে করতো, মৃতেরা একসাথে হয়ে সিন্ধুঘোটকের মাথার খুলি নিয়ে ফুটবল খেলছে। আল্‌গঙ্ক্যুইন উপজাতীয়রা মনে করতো, তা’দের স্রষ্টা নানাবঝ্‌হো আগুন জ্বালিয়ে জানান দিচ্ছেন যে তিনি তা’দের নিয়মিত দেখভাল করছেন। গ্রীনল্যাণ্ডে ধারণা ছিল, এই আলো আসলে মৃতজাত বাচ্চাদের আত্মা। সামি-রা মনে করতো, অনেক দূরে মহাসাগরে তিমি মাছের পাল থেকে উদ্বীর্ণ পানির গাঁজলাই হচ্ছে এই আলোকচ্ছটা। গ্রীকরা মনে করতো, চন্দ্র ও সূর্য্যদেবের ভগ্নী ঊষাদেবী আকাশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে তাঁর রঙিন রথে করে ছুটে চলার সময় এই বহুবর্ণের দীপ্তির সৃষ্টি হতো। এই গ্রীক দেবীর নামেই এই মেরুপ্রভাকে বলা হয় আরোরা। বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে ব্যাপারটা কিন্তু আরও বেশী কৌতূহলোদ্দীপক। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কিছু ইলেকট্রন, প্রোটন প্রভৃতি দিয়ে তৈরী হয় সৌরঝড় । এই সৌরঝড় যখন তীব্র শক্তি নিয়ে পৃথিবীর উপর আসতে চায়, তখন বায়ুমণ্ডলের চৌম্বক-আবহ বা ম্যাগনেটোস্ফিয়ার একে বাধা দেয় । সংঘর্ষের কারণে পরমাণু বা অণুসমূহ কিছু শক্তি লাভ করে চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয়। এসব অভ্যন্তরীণ শক্তি যখন আলোকশক্তি হিসেবে বিকরিত হয়, তখনই মেরুপ্রভা বা অরোরা দেখা যায়। সুমেরুতে যে মেরুপ্রভা দেখা যায়, তা’কে বলে অরোরা বোরালিস, আর কুমেরুর মেরুপ্রভাকে বলে অরোরা অস্ট্রালিস।

তা’ এই মেরুপ্রভা দেখতেই ট্রম্‌সৌতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে। আমরাও এসেছি একই কারণে। কিন্তু মুস্কিল হলো, এই অরোরার দেখা পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। যদিও এই প্রভা সর্বদাই আকাশে থাকে, কিন্তু আলো বা মেঘের কারণে একে সবসময় দেখা যায় না। তাই পর্যটকরা এই মেরুপ্রভাকে তাড়া করে বেড়ায় বিভিন্ন মেরু অঞ্চলে। আজ রাতে আমরা তাড়া করবো অরোরাকে। ভাগ্য কি প্রসন্ন হবে আমাদের! পারবো কি উষাদেবীর দর্শন পেতে!

Friday, February 14, 2020

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ৩

 সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ৩ঃ

ঘুম যখন ভাঙলো, সূর্য্য ওঠেনি তখনও। হোটেল-কামরার তাপ-নিয়ন্ত্রিত উষ্ণ বিছানাটা ছাড়তে যে যথেষ্ট মনের জোর লেগেছিল, তা’ বলাই বাহুল্য। কিন্তু গাড়ীওয়ালাকে বলা ছিল সকাল ৬টায় বেরুবো। তাই, কাপড়জামা পরে তৈরী হয়ে বের হতেই হলো। গতসন্ধ্যার হাঁড়-কাপানো অভিজ্ঞতার পর আজ আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করলাম না। প্রথমে থার্‌মাল, তার ওপর পাতলা সোয়েটার, তারপর ফ্লানেলের জামা, তুলাভর্তি হাতকাটা কোট, আর সবার ওপর একটা লম্বা মোটা জ্যাকেট – এই পাঁচ স্তরের বর্ম পরে বের হলাম শীতের সাথে যুদ্ধ করতে। উত্তমাঙ্গ যদিও নিরাপদ; পা-জোড়া নিয়ে একটু চিন্তা থেকেই গেল।

এক মগ গরম কফি দিয়ে শরীরটাকে তাজা করে বেরিয়ে পরলাম রাস্তায়। গন্তব্য অস্‌লো – নরওয়ের রাজধানী। মাঝে পেরুতে হবে সুইডেন। কোপেনহাগেন থেকে মোটামুটি মিনিট কুড়ি পরেই সুইডেনের সীমানা। ওরেযুন্ড প্রণালীর উপর দিয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার লম্বা এক সেতু ডেনমার্ক আর সুইডেনের দূরত্বকে অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। এই সেতুর মাঝামাঝি থেকেই সুইডেনের সীমান্ত শুরু। সেতুর শেষে একটি নামমাত্র শুল্ক ও অভিবাসন কেন্দ্র আছে ঠিকই, কিন্তু অত সকালে কেউই কাজে আসেনি। আমরা তাই বিনা বাঁধায় ঢুকে পড়লাম ইউরোপের আরেকটি দেশে। এধরণের প্রায়-মুক্ত সীমানা কি হতে পারেনা আমাদের উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে! ইংরেজদের তাড়াহুড়ো করে ইচ্ছেমাফিক করা দেশভাগ কত মানুষকে যে ভিটেমাটি-হারা করেছে। ধর্মের নামে ভাগ করে নতুন জাতিসত্ত্বা তৈরী করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস, কৃষ্টি, ভাষা – এসব তো একই রয়ে গেছে। সেই মানুষগুলোকে কেন অন্ততঃ অবাধে চলাচল করতে দেওয়া যায় না! কেন নিজের আপনজনের সাথে মিলিত হতে হলে সরকারের অনুমতি লাগে! বিচ্ছিন্নতাবাদের এই যুগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা অনুকরণীয় আদর্শস্বরূপ। এজন্য এই মহাদেশের মানুষগুলোকে আমার স্যালুট জানাই!

ঘন্টা তিনেক পর ক্ষিদে চেপে ধরলো। গাড়ীচালককে বলে কাছাকাছি এক ছোট শহরে থামলাম আমরা। বার্গার আর স্যাণ্ডঊইচ দিয়ে পেটকে শান্ত করে আবার গাড়ীতে উঠতে গিয়ে দেখি, গাড়ীর চাকায় হাওয়া নেই। কী আর করা! গাড়ীচালক পাকিস্থানী বনশোদ্ভূত বাসারাত-কে বললাম চাকা সারিয়ে আনতে; ততক্ষণ কাছের একটা ছোট দোকানে ঢুকে এটা ওটা দেখতে দেখতে কালক্ষেপন করতে থাকলাম। ঘন্টাখানেক বাদে বাসারাত মিঞা চাকা বদলে ফিরে এলেন। আবার যাত্রা শুরু। সাত ঘন্টার পথ, বাকি আরও চার ঘন্টা। সুইডেনের রাস্তা দিয়ে একশ’ কিলোমিটার বেগে চলেছি আমরা। গাড়ীচালককে তাড়া দিতে সে জানালো, এই ভাড়ার গাড়ীর গতিবেগ পুলিশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। একশ’-র বেশী যাওয়ার কোন উপায় নেই। এছাড়াও গাড়ীতে একটি যন্ত্র বসানো আছে, যা দিয়ে পুলিশ এই গাড়ীর উপর সর্বক্ষণ নজর রাখতে পারে। তাই নিয়ম ভাঙার জো নেই! পুলিশের এই তদারকিতে বেশ অবাক হলাম আমি; মনে মনে তারিফও করলাম। আমাদের পুলিশ-বাহিনীর যে কতকিছু শেখার আছে এখনও!

কিছুদূর পরপর সারি সারি প্রকাণ্ড বাতচক্র বা উইণ্ডমিল দেখতে পাচ্ছিলাম। বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে। কয়লা, গ্যাস, তেলের উপর থেকে এরা নির্ভরতা কমিয়ে নিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বৈশ্বিক উষঙ্গতাকে ইউরোপিয়নরা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। রাস্তায় আজকাল প্রায়শঃই বিদ্যুৎচালিত গাড়ী এখানে দেখতে পাওয়া যায়। আর পরিবেশ-বান্ধব সাইকেলের তো কথাই নেই! এককালে জানতাম চীনেরা শুধু সাইকেল চালায়। এখন ব্যাপারটা উল্টো। ওরা এখন নতুন পয়সা পেয়ে বড় বড় তেল-পিপাসু গাড়ীতে চড়ে, আর বিশ্বসেরা গাড়ী-প্রস্তুতকারী ইউরোপীয়নরা এখন পদচালিত দ্বিচক্রযান চালিয়ে পরিবেশকে নির্মল রাখার চেষ্টা করে। ডেনমার্কে নাকি লোকসংখ্যার দ্বিগুণ সাইকেল আছে; অর্থাৎ অনেকেরই একটির বেশী রয়েছে। রাস্তাঘাটও সাইকেল-বান্ধব; আলাদা করে নির্দেশিত ও সংরক্ষিত সাইকেল-পথ আছে। সাইকেল-চালক ও পথচারীদের এখানে পথাধিকার অধিকতর। আমাদের ট্রাক যেমন পথের রাজা, এখানে রাজা সাইকেল! গাড়ীওয়ালারা এদের বেশ সমীহ করেই চলেন। আমাদের দেশে ‘রাইড-শেয়ারিং’-এর নামে হঠাৎ করেই মোটরসাইকেলের উৎপাত ইদানীং বেড়ে গেছে। ‘উৎপাত’ বললাম একারণে, যে এরা নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রায়শঃই কথা নেই বার্তা নেই ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে। গাড়ীর সারির ফাঁকফোঁকর দিয়ে, বা কখনও ফুটপাতের ওপর দিয়ে চলে এই মোটসাইকেলওয়ালারা। আসলে আমাদের ‘রাইড-শেয়ারিং’-এর পুরো ধারণাটাতেই গলদ রয়েছে। আমেরিকায় উবার রাইড-শেয়ারিং শুরু করেছিল এমনভাবে যে, কেউ তা’র নিজের গাড়ীতে অন্য কাউকে পয়সার বিনিময়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেবে, অর্থাৎ সে তা’র রাইড বা যাতায়তটা আরেকজনের সাথে শেয়ার করবে। আমাদের দেশের এই সেবাগুলো সত্যিকার অর্থে ‘শেয়ারিং’ তো নয়ই, বরং মোটরসাইকেলে এই সেবা প্রদানের অনুমতি দিয়ে আমরা কি তা’দের ট্রাফিক আইন ভাঙার বৈধ্তা দিচ্ছি না! গাড়ি শেয়ারিং না করে মোটরসাইকেল শেয়ারিং করা হছে, কারণ যানযটের মধ্যে পাশ কাটিয়ে লালবাতি উপেক্ষা করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে; অর্থাৎ ট্রাফিক আইনকানুনের পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে!

সুইডেন পার হয়ে নরওয়েতে ঢোকার মুখেও অতি হালকা একটু লোক-দেখানো সীমারক্ষার আয়োজন। ড্রাইভারকে শুধু জিজ্ঞেস করলেন এক পুলিশ কর্মচারী যে কোথায় যাচ্ছে আমদের গাড়ী। ড্রাইভার উত্তর দিতেই ইশারায় যেতে বলা হলো আমাদের। ডেনমার্ক, সুইডেন পেরিয়ে নরওয়ে। একই দিনে তিন তিনটি দেশ পাড়ি দিলাম আমরা। আশেরপাশের দৃশ্যের অবশ্য তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়লো না। সেই একই ধরণের বাড়ীঘর, শষ্যক্ষেত, আর কিছুদূর পরপর বাতচক্ররাজি। অস্‌লো আসতে আরও কিছু পটহ বাকি। আমাদের এযাত্রা চূড়ান্ত গন্তব্য অস্‌লোর বিমানবন্দর। সেখান থেকে বিমানে চেপে যাবো ট্রম্‌সৌ, সুমেরুবৃত্তের মধ্যে।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বিমান যখন ট্রম্‌সৌ-তে নামলো, তখন আকাশে তুষারঝটিকা হচ্ছে। অনেকদিন পর তুষারপাত দেখলাম। মনে পড়ে গেল, ‘বাক্স-রহস্য’-তে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, বরফ পড়ার কোন শব্দ হয়না। উত্তর-মেরু আমাদের স্বাগত জানালো এক ভারী নিশব্দ তুষারপাত দিয়ে। বিমানবন্দর থেকে বেড়িয়ে দেখি চারিদিক সাদা বরফে ঢাকা। রাস্তায়ও বরফ জমে আছে; কিছু কিছু জায়গায় উপরের স্তরটা গলে পিচ্ছিল হয়ে আছে পথ। ট্যাক্সির জন্য লাইন দিয়ে আছে জনা পঞ্চাশেক। কিন্তু লাইন-ভাঙাতে স্বভাবজাত পটু বাঙালীকে তো আর এতবড় লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়না! অতি সাবধানে উল্টো দিকে গিয়ে এক ট্যাক্সিওয়ালাকে ধরলাম। মালামাল উঠিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। সারাদিন ধরে যাত্রাপথে আছি; গন্তব্যে এসে এটুকু ফাঁকিবাজিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেই পারেন।

হোটেলের রুমে ঢুকে মনটা ভাল হয়ে গেল। ততক্ষণে বরফ পড়া থেমেছে। জানালা দিয়ে দেখি, সামনে উপসাগর, ওপারে তুষারাবৃত উঁচু পাহাড়, গাড়ী-বাড়ী-দোকানপাট সব বরফে মোড়া। দূরে দেখা যাচ্ছে ট্রম্‌সৌর বিশেষ আকর্ষণ সেই ত্রিকোণ ট্রমসডালেন গীর্জা। কাল থেকে মেরু-অভিযান শুরু। উত্তেজনায় আজ রাতটা কাটবে তো!




















Thursday, February 13, 2020

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ২

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ২ঃ

ইউরোপের এত সুন্দর একটা শহরের এমন শ্রুতিকটুর নাম কে দিয়েছিল কে জানে! শুনলেই মনে হয় কেউ যেন খনন-কার্য্য সম্পন্ন করতঃ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ব্যস্ত! কোপেনহাগেন-এর গোড়াপত্তন হয় দশম শতাব্দীতে। জেলেরাই থাকতো তখন এখানে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এটিকে ডেনমার্কের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ৬৮২ বর্গমাইলের এই শহরে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ লোকের বাস। অর্থাৎ, আমাদের ঢাকার ধানমণ্ডি বা গুলশানের যে জনবসতি, এখানে তার চেয়েও কম মানুষের বসবাস! আজ অপরাহ্নে কোপেনহাগেন বিমানবন্দরে অবতরণ করেই ঠাণ্ডা আবহাওয়ার সাথে মোলাকাত হলো। আমিরাতী বিমানের সৌজন্যে দেওয়া গাড়ীতে করে হোটেলে পৌঁছুতে বেশী সময়

লাগলো না। হাতমুখ ধুয়ে একটু তরতাজা হয়ে, গায়ে একখানা সোয়েটার আর একটা কোট চড়িয়ে বেরিয়ে পরলাম শহর দেখতে। ট্যাক্সি করে যখন শহরকেন্দ্রে পৌঁছুলাম, ততক্ষণে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একে ৪ ডিগ্রী তাপমাত্রা, তার উপর বৃষ্টি আর থেকে থেকে বাতাস; মনে হচ্ছিল হাত-পা জমে পাথর হয়ে যাবে। ভাগ্যিস একজোড়া দস্তানা এনেছিলাম সাথে। ওটা না থাকলে হাত আর মুঠো করতে পারতাম না! মনে মনে দ্বিগুণ শিউরে উঠলাম উত্তর-মেরুর কথা ভেবে। চার ডিগ্রীতেই যদি এ হাল হয়, তা’হলে সুমেরুতে হিমাঙ্কের নীচে যখন তাপমাত্রা হবে, তখন কী হবে আমার! যথেষ্ট গরম কাপড় এনেছি তো! সুমেরুর শীত নিবারণ করতে পারবে তো সে সব! গায়ে না হয় কয়েক স্তরে জামা পরা যাবে; পায়ে কী হবে! ঠাণ্ডার মধ্যে এমন হু হু বাতাস বইলে তো হাড় কাঁপিয়ে দেবে!

নিজেকে বেশ শৈত্যজয়ী মনে হত আমার। তাই সত্যিকারের শীতবস্ত্র কখনই আমার সংগ্রহে ছিল না। এবার সাথে করে আনা কাপড়গুলোও অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই নিয়ে আসা। স্ত্রীর জোরাজুরিতে আজ বেরোনোর সময় তিনস্তরের কাপড় পরে মনে মনে লজ্জাই পাচ্ছিলাম। কিন্তু, ট্যাক্সি থেকে নামার সাথে সাথে যে ধাক্কাটা পেলাম, তা’তে আমার শৈত্যজয়ের ঔদ্ধত্য নিমেষে উড়ে গেল! ঠাণ্ডার ধারালো ছুরির

হাত থেকে পালানোর জন্য সামনে একটা রেস্তোরাঁ পেয়েই ঢুকে পড়লাম সেখানে। লেবানীজ খাবারের দোকান। ভাইকিং-এর দেশে এসে কিনা ভূমধ্যসাগরীয় খাবার খাবো! কিন্তু, এই ঠাণ্ডার সাথে যুদ্ধ করতে হলে একটু দম নিতেই হবে। অগত্যা শর্মা আর ফালাফেল খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করলাম। গা একটু গরম করে, মাথা ঢেকে, দস্তানা পরে রাস্তায় নামতেই কনকনে হিমেল বাতাস জানান দিয়ে গেল, এত হালকায় কাজ হবে না! বোঝার আর বাকি রইলো না যে, হিমাঙ্কের নীচে যে তাপমান হবে সুমেরুতে, তা’ মোকাবেলা করতে হলে আরও সাজসরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। কাছেই একটা দোকানে পেয়ে গেলাম উলের মোজা। সবথেকে মোটা মোজা জোড়া কিনে নিলাম পা-দুটোর রক্ষাকবচ হিসেবে। যদিও সাথে আনা গরম কোটগুলোর সাথে ঘোমটার ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও কান ঢাকার একটা অতিরিক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।


ওস্টারগাডে-তে পায়ে হাঁটার রাস্তা, আর তার দু’পাশে দোকানপাট। এসব রাস্তায় মোটরযান চলা নিষিদ্ধ। ইউরোপের প্রায় সব পুরনো শহরেই এরকম পেডাস্ট্রিয়ান মল বা পাদচারী চত্ত্বর আছে। হালফ্যাশনের দোকান, ভাল রেস্তোরাঁ ইত্যাদি এসব জায়গায় থাকে। কোপেনহাগেনও এর ব্যতিক্রম নয়। শীত উপেক্ষা করেই ঘন্টা দুই হেঁটে বেরালাম আমরা শহরকেন্দ্রের অলিগলিতে। কাল অস্‌লোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো; শরীরটাকে তো একটু ধাতস্থ করতে হবে ঠাণ্ডার সাথে। একটা কফিখানায় ঢুকে এক মগ গরমা-গরম কফি খেয়ে দেহকে উষ্ণ করে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। ট্যাক্সিওয়ালার নাম ফারুক, আমাদেরই উপমহাদেশীয়, যদিও এখানেই তা’র জন্ম আর বেড়ে ওঠা। বললাম, শহরটাকে একটু ঘুরে দেখাতে। বেশ উৎসাহ নিয়ে সে আমাদের নিয়ে গেল সপ্তদশ শতাব্দীর নাইহাওন বা নতুন বন্দরে। নাইহাওন খালের পাশ দিয়ে নানান রঙের সারি সারি বাড়ীর সমন্বয়ে এই সাড়ে চারশো মিটার লম্বা বন্দরটি একসময়ে ব্যবহার হতো সমুদ্রপথের সাথে যোগাযোগ হিসেবে। ‘লিট্‌ল মারমেড’ খ্যাত জনপ্রিয় রূপকথা-শিল্পী হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন বাস করতেন এখানে। বর্তমানে এ জায়গাটি একটি পর্যটন দ্রষ্টব্য। নৌকা ভাড়া করে এই খালে ভমণ করা যায়; যদিও সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় এ যাত্রা সেটির আর সময় হলো না আমাদের। সুমেরু থেকে যদি না জমে গিয়ে ফিরতে পারি, তখন চেষ্টা করবো এই খালভ্রমণের। কোপেনহাগেনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ‘লিট্‌ল মারমেড’-এর একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি রয়েছে এ শহরের ল্যাঙ্গিলিনিতে। আগে বার দু’য়েক গিয়েছি দেখতে আমার ছোটবেলার অতিপরিচিত সেই মৎস্যকন্যাকে দেখতে। এবার অবশ্য আর যাওয়া হলো না।

কোপেনহাগেন বন্দরে অপেরা হাউজের অপর পাড়ে বছর দুই আগে ফ্রস্ট উৎসবের সময়ে ‘দ্য ওয়েভ’ নামের ৮০ মিটার লম্বা ত্রিকোণ এলইডি বাতির একটি মিথষ্ক্রীয় প্রতিস্থাপনা তৈরী করা হয়েছিল। ত্রিভূজাকার সুড়ঙ্গপথে মানুষ হেঁটে গেলে নানান বিদ্ঘুটে সব অতিপ্রাকৃত আওয়াজ হতে থাকে। অনেকটা ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর ভূতের রাজার মত। আলো জ্বলছে, নিবছে, অদ্ভুতুড়ে কন্ঠে কী যেন সব বলছে! জনপ্রিয়তার কারণে স্থাপনাটিকে এখনও রেখে দেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে কিছু ছবি তুললাম আমরা। এরপর একে একে আমালিয়েনবর্গ রাজপ্রাসাদ আর টাউন-হল হয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। দোকানপাট সবই বন্ধ হয়ে গেছে ৬টা নাগাদ। হাতে গোনা দু’একটা খোলা পাওয়া যেতে পারে, তা’ও বড়জোর রাত ৮টা পর্যন্ত। এরপর কোপেনহাগেন পুরোপুরি ঘুমন্ত। বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর স্থাপনা, প্রতিকৃতি, ভবন এখানে রয়েছে বটে, তবে সেগুলো কোনটাই ন্যায্যভাবে প্রদর্শিত নয়। কিছু বাতি দিয়ে এগুলোকে সুন্দর করে প্রদর্শন করা যেতেই পারে। কিন্তু ড্যানিশরা হয় আত্মপ্রচার পছন্দ করে না, নতুবা রাতের অন্ধকারে এগুলোকে যে বাতি জালিয়ে দেখানো যেতে পারে, সেটা তা’দের মাথায়ই আসে না। রাতে তো মানুষ ঘুমায়, দেখবে কে!

শর্মা আর ফালাফেল এখনও পাকস্থলী জবরদখল করে রেখেছে। তাই নৈশভোজনটা বাদ দেওয়া হলো। কাল ভোর ছ’টায় গাড়ী এসে তুলে নেবে আমাদের নরওয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য। তাপমাত্রাটা তখন কত নীচে থাকে তা’ নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন আছি। যাই, শৈত্যজয়ীর খেতাবটা জলাঞ্জলি দিয়ে জামার স্তর ক’টা বাড়াবো তা’র হিসেব করি গিয়ে।

Tuesday, February 11, 2020

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ১

সুমেরু-যাত্রীর ডায়েরী – পর্ব ১ঃ

বিশালাকার ৩৮০-৮০০ আমিরাতী বিমানে চড়ে বাসরা, বাগদাদ, মসুল, আঙ্কারা পেরিয়ে কৃষ্ণসাগরের উপর দিয়ে ৩৮,০০০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ে চলেছি ডেনমার্কের রাজধানীর উদ্দেশ্যে। গতকাল মধ্যরাতে ঢাকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যমণি দুবাইতে এসে পৌঁছেছিলাম। বিমানবন্দরের ভেতরেই অবস্থিত হোটেলে রাত্রিযাপন করে আজ সকালে শুরু করলাম আমাদের যাত্রার দ্বিতীয় অধ্যায়। দুবাইয়ের বিমানবন্দর হোটেলটি আর যেকোন তিন-তারকা হোটেলের মতই। বেশ বড় কামরায় টেলিভিশন, ফ্রীজ, ইস্ত্রি, লকার সবই ছিল। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতে না দিতেই যত রাজ্যের ঘুম এসে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছিল। ভাগ্যিস্‌ ঘুম-ভাঙানোর স্বয়ংক্রিয় সংকেত-ব্যবস্থাটা করে রেখেছিলাম, না হলে ভোর সাড়ে ছ’টায় কখনই উঠতে পারতাম না! ট্রেনে চেপে অন্য টার্মিনালে গিয়ে বিমানে চড়তে হয়েছিল আমাদের। অবশ্য এর মধ্যেই লাউঞ্জে গিয়ে প্রাতঃরাশটা সেরে নিয়েছিলাম তাড়াহুড়ো করে। কাল রাতে যখন নেমেছিলাম, সারা বিমানবন্দরটা কেমন যেন খা খা করছিল। দুবাইয়ের এই জনপ্রিয় অতিক্রমণস্থলটি সাধারণতঃ দিনরাত লোকে গমগম করে। হরেক রকমের নামীদামী দোকানপাটে ভরা এই বিমানবন্দরটি যেকোন আধুনিক শপিংমলের সাথে পাল্লা দিতে পারে। ঘড়ি, সোনার গয়না থেকে শুরু করে কাপড়চোপড়, চকোলেট সবই পাওয়া যায় এখানে। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলে লটারীতে দামী গাড়ীও জিতে যেতে পারেন এখান থেকে। অবশ্য সেই গাড়ী নিয়ে দেশে কী করে ফিরবেন, সেটা অন্য কথা! তো সেই লোকপ্রিয় বাজারস্থল তথা বিমানবন্দরের এই লোকহীন হাল কী করে হলো চিন্তা করতেই পাশ থেকে একদল মুখোশ-পরা ইউরোপীয় যাত্রী হেঁটে চলে গেলেন। বুঝলাম করোনা-ভাইরাস আতঙ্কের অবদান এটি। মাস তিনেক আগে চীনের ভূহান প্রদেশে এই নতুন প্রজাতির ভাইরাসের ‘উৎপত্তি’ হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত আট-শতাধিক জীবনহানির খবর পাওয়া গেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের মধ্যে একটা ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়েছে। বিমানভ্মরণও কমে গেছে তাই উল্লেখযোগ্যভাবে। আমার কেন জানি মাঝেমাঝে মনে হয়, এসব নতুন নতুন ভাইরাস মানুষেরই তৈরী। কখনও ওষুধ কোম্পানীগুলোর প্ররোচনায়, আবার কখনও বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গোপন গবেষণাগারে জৈব-অস্ত্র হিসেবে তৈরী করা হয় এসব জীবাণু। কখনও ইছাকৃত ভাবে ছড়ানো হয় সেগুলো, আবার কখনও বা ভুলবশতঃ কিংবা দুর্ঘটনাবশতঃ ছড়িয়ে পড়ে কৃত্তিম উপায়ে তৈরী এসব ভাইরাস। কে জানে, হয়তো বা এসব ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব পুরোটাই আমার কল্পনা, বেশীমাত্রায় হলিউডের সিনেমা দেখার ফসল!

উত্তর-মেরুর যাত্রাপথটা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছি আমরা। দুবাইয়ে প্রথম যাত্রা-বিরতির পর কোপেনহাগেন; সেখানে একরাত কাটিয়ে অস্‌লো; তারপর সেখান থেকে নরওয়ের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত ট্রমসৌ শহর। এই ট্রমসৌ আর্ক্টিক সার্কেল বা সুমেরু-বৃত্তে অবস্থিত। সুমেরুর কেন্দ্রবিন্দুটি উত্তর মহাসাগরের মধ্যিখানে; জাহাজে চেপে সেখানেও যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। মেরু মানেই বরফ, আর বরফ মানেই ঠাণ্ডা! সেই ছোটবেলা থেকে সারা শরীর ঢাকা মোটা কাপড় আর পশমের টুপি পড়া গ্রীণল্যাণ্ডের এস্কিমোদের ছবি দেখে এসেছি। আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটা সেই গ্রীণল্যাণ্ডেরও উত্তরে। দু’ স্যুটকেস বোঝাই করে যদিও শীতের মোটা কাপড় নিয়েছি সঙ্গে, তবুও মেরুর শীত তা’তে সামাল দিতে পারবো কি না বলা মুস্কিল!

আমাদের বিমানে একটি আলাদা বৈঠকখানা ও পানশালা রয়েছে। সাত-ঘন্টার যাত্রাপথে নিজের সীটে বন্দি হয়ে বসে না থেকে যাত্রীরা যাতে সেখানে গিয়ে একটু হাত-পা ছড়াতে পারেন, সে জন্যই এ ব্যবস্থা। এক ড্যানিশ ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হলো সেখানে। কোপেনহাগেন-এ কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, এমন কিছু উল্লেখযোগ্য জায়গার নাম বলে দিলেন তিনি। আমি আগে বার দু’য়েক সেখানে গিয়েছি, কিন্তু প্রতিবারেই মিটিং আর কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, খুব বেশী শহরটাকে ঘুরে দেখার সুযোগ পাইনি। এবার একেবারেই আনন্দভ্রমণ, কাজকামের বালাই নেই। তাই ভাইকিংদের এই শহরটকে কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে এ দফা!